IQNA

উপনিবেশিক শাসনের অবসান এবং বিশ্বজুড়ে শরিয়া আইনের প্রয়োগ

20:34 - April 19, 2019
সংবাদ: 2608373
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: অধ্যাপক মার্ক ফাথি মাসুদ,ওয়াশিংটন: ইসলামি উগ্রপন্থীরা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ধর্মীয় আইন চালু করতে চায় এমন অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রের উগ্র ডান পন্থী কিছু আইন প্রণেতা দেশটির কয়েক ডজন অঙ্গরাজ্যে ইসলামি শরিয়া নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শরিয়া একটি আরবি শব্দ এবং ইসলামি আইন বুঝতে হলে শরিয়া শব্দটি সম্পর্কে জ্ঞান রাখা প্রয়োজন।

বার্তা সংস্থা ইকনা: এসকল উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিকরা মধ্য প্রাচ্যের রাজনৈতিক সংঘাত এবং সন্ত্রাসবাদের যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চায় যে, ইসলাম মূলত আধুনিক সমাজের সাথে খাপ খায় না। এর মাধ্যমে তারা মুসলিম বিশ্ব সভ্য নয় এমন প্রথাগত প্রচারণা চাপিয়ে দিতে চায়।

তারা একই সাথে শরিয়াকে পাশ কাটিয়ে যেতে চায় যা আসলে অতি কঠিন কোনো আইন নয়। শরিয়ার অর্থ হচ্ছে ‘পথ’ বা ‘উপায়’। শরিয়ার মূল উৎপত্তি হয়েছে পবিত্র কোরআন এবং নবী মুহাম্মদ(সা:) এর জীবনী থেকে।

১৯৫০ এবং ১৯৬০ সালের দিকে যখন ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং অন্যান্য ইউরোপিয়ান শক্তি সমূহ মধ্য প্রাচ্য, আফ্রিকা এবং এশিয়াতে তাদের ক্ষমতা হারাতে থাকে তখন নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নেতারা একটি সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খেয়েছেন আর তা হচ্ছে তারা কি তাদের সরকার ব্যবস্থায় ইসলামি মূল্যবোধের প্রয়োগ করবেন নাকি পূর্ব থেকে চর্চিত হওয়া ইউরোপের উপনিবেশিক আইনের প্রয়োগ চালিয়ে যাবেন?

সবচেয়ে বড় বিতর্ক
আমার গবেষণায় আমি দেখতে পাই যে, সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত এসব নতুন দেশের রাজনৈতিক নেতারা তাদের বিচার ব্যবস্থায় ধর্মীয় আইন চালুর বদলে উপনিবেশিক আইন চালু রেখেছিল।

নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত সুদান, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান এবং সোমালিয়াসহ অন্যান্য মুসলিম দেশ তাদের সেনা এবং উত্তরাধিকার বিষয় সমূহের ক্ষেত্রে মুসলিম পরিবার সমূহের জন্য উপনিবেশিক আমলের আদলে শরিয়া আইন চালু করেছিল। আর অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা ইউরোপিয়ান আইন চালু রাখে।

তারা কেন এমনটি করেছিল তা জানতে আমি সুদানের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে গবেষণা চালাই। এই দেশটি হচ্ছে প্রথম আফ্রিকান কোনো দেশ যা ১৯৫৬ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।

সুদানের জাতীয় সংরক্ষণাগার, লাইব্রেরি সমূহ এবং দেশটির আইনজীবী গণ, সরকারি কর্মকর্তাগণের সাক্ষাতকার নেয়ার পরে আমি বুঝতে পেরেছি যে, দেশটির শীর্ষস্থানীয় বিচারকগণ, রাজনৈতিকগণ এবং বুদ্ধিজীবীগণ আসলে সুদানকে একটি গণতান্ত্রিক ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান।

তারা ইসলামি বিশ্বাসের সাথে সংমিশ্রণ করে এমন একটি আইনি ব্যবস্থা কল্পনা করেন যেখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতি ইত্যাদি নির্বিশেষে সকল বিশ্বাসের মানুষ জন স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারেন।

১৯৫৬ সালের সুদানের সুপ্রিম আদালতের বিচারক হাসান মুদ্দাথির লিখেছিলেন, ‘আমাদের জনগণ দাঁত এবং চিরুনির মতই সমান।’

হাসাল মুদ্দাথিরের লিখা একটি পাণ্ডুলিপি দেশটির রাজধানী খারতুমের একটি লাইব্রেরিতে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। তিনি হযরত মুহাম্মদ(সা:) এর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেন- ‘একজন আরব একজন পারসিয়ানের চাইতে বড় নয় এবং একজন শ্বেতাঙ্গ একজন কৃষ্ণাঙ্গের চাইতে বড় নয়।’

তবে সুদানের পরবর্তী নেতারা এমন ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা উপনিবেশিক আমলের আইন এবং ঐতিহ্য চালিয়ে নিতে চান।

শোষকদের আইন কেন ধরে রাখা হয়েছিল?
আমার গবেষণায় আমি এর সপক্ষে তিনটি কারণ খুঁজে পেয়েছি: রাজনীতি, বাস্তববাদ এবং জনসংখ্যা তত্ত্ব।

সদ্য স্বাধীন হওয়া সুদানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতার গ্রহণের জন্য সৃষ্টি হওয়া শত্রুতা তাদেরকে আইনসভা অবধি নিয়ে গিয়েছিল। আর এর ফলেই তাদের জন্য একটি অর্থবহ আইনি ব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটানো কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছিল। এভাবেই সুদানে উপনিবেশিক আমলের আইনের প্রয়োগ চলতে থাকে।

উপনিবেশিক আইন চালু রাখার কিছু রাজনীতিকারণ ছিল।

সুদানের বিচারকগণ ব্রিটিশ উপনিবেশিক কর্মকর্তাগণ দ্বারা প্রশিক্ষিত ছিলেন। সুতরাং উপনিবেশিক আইনের প্রয়োগ তাদের জন্য সহজতর ছিল।

সুদানের প্রতিষ্ঠাতাদের কাছে দেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং গৃহ যুদ্ধের অবসান করার মত অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। আর তাই তারা নতুন একটি আইনের প্রয়োগের মত ঝামেলার কাজ এড়িয়ে গেছেন।

উপনিবেশিক আইন চালু রাখার ক্ষেত্রে সুদানের জাতিগত, ভাষা-গত এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্য কাজ করেছে।

তখনকার এমনকি এখনকার সুদানিরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলেন এবং তাদের মধ্যে বিভিন্ন জাতি ভেদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। সদ্য স্বাধীন সুদানের বেশীরভাগ জনগোষ্ঠী সুন্নি এবং সুফি ইসলামের চর্চা করতো একই সাথে খ্রিষ্টান ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল।

সুদানের বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্ম বিশ্বাসী সমাজের জন্য নতুন শরিয়া আইন চালুর চাইতে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান উপনিবেশিক আইন চালু রাখা সহজ ছিল।

উগ্রপন্থীরা কেন জয়লাভ করে?
আমার গবেষণায় আমি দেখতে পেয়েছি যে, বর্তমানে মধ্য প্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা জুড়ে যে অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান তা আসলে উপনিবেশিক আমলের অবসানের পরে শরিয়া আইন বাস্তবায়ন না করার প্রত্যক্ষ ফলাফল।

উপনিবেশিক আইনি ব্যবস্থা চালু রাখতে গিয়ে সুদান সহ অন্যান্য মুসলিম দেশ সমূহ মূলত পশ্চিমা শাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল যা তাদের কে উপনিবেশিক আমলের ধর্ম নিরপেক্ষ নীতির দিকে ঠেলে দেয়।

কিন্তু তারা একই সাথে ধর্মীয় পরিচয় এবং ধর্মীয় আইন প্রয়োগের মত কঠিন প্রশ্ন সমূহ কে এড়িয়ে গিয়েছেন।
আর এভাবেই দীর্ঘ মেয়াদে এসকল সরকার তাদের নিজ দেশের গভীর ধর্ম বিশ্বাসী নাগরিকদের মতামত উপেক্ষা করে গিয়েছেন।

অন্যকথায় ১৯৫০ এবং ১৯৬০ সালের পরের উপনিবেশিক আমলের শেষ পর্যায়ে মুসলিম দেশ সমূহ যেভাবে শরিয়া কে এড়িয়ে চলেছিলেন তার ফলাফল সরূপ বর্তমানে শরিয়া উগ্রপন্থীদের হাতে এসে পৌঁছিয়েছে।

ধর্ম এবং বিশ্বে প্রচলিত আইন
১৯৪৮ সাল ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর ইসরাইলি সমাজে ইহুদি আইন প্রচলন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল। আর চূড়ান্ত ভাবে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ান এবং তার মিত্ররা ইহুদি আইন এবং উপনিবেশিক আইনের মিশ্রণে একটি আইন কাঠামো দাঁড় করিয়েছিল।

ল্যাটিন আমেরিকায় স্প্যানিশ বিজেতারা ক্যাথলিক আইন চালু করে যা গর্ভপাত, বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সমকামিতা নিষিদ্ধ করেছিল।

আর ১৯ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিচারক প্রতিনিয়ত আইনের একটি ম্যাক্সিমের প্রয়োগ করতেন আর তা হচ্ছে- ‘খ্রিষ্টান ধর্ম কমন আইনের একটি অংশ।’

কিন্তু মুসলিম দেশ সমূহে যখন শরিয়া আইনের প্রচলন করা হয় তখন একটি বৈষম্য সৃষ্টিকারী আইন হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়।

মৌলবাদ এবং সংঘাত মূলত উপনিবেশিক শাসনের অবসান হওয়ার পরবর্তী একটি সমস্যা এর সাথে ধর্মের কোনো সংযোগ নেই।

মুসলিম দেশ সমূহের জন্য ৫০ বছরের ধর্ম নিরপেক্ষ আইনের ব্যর্থতার পর ইসলামিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি সরকার খুঁজে বের করা সহজ সাধ্য কোনো কাজ নয়। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এটি জরুরী। দিকনভার্সেশন ডট কমে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মার্ক ফাথি মাসুদের কলাম থেকে। /আরটিএনএন

 

captcha