IQNA

কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দীর্ঘ ইতিহাস

23:11 - August 13, 2019
সংবাদ: 2609070
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মোদি সরকারের ভারতীয় সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা বাতিল নিয়ে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশটির রাজনীতি। ব্যাপক আন্দোলনের আশঙ্কায় কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে গোটা কাশ্মীর অঞ্চল। পুলিশের সঙ্গে কাশ্মীরিদের দফায় দফায় সংঘর্ষের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। গত তিন দশকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে কাশ্মীর এখন ফুটছে। ৩৭০ ধারা বাতিলের পূর্বেও রাষ্ট্রীয় মদতে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।

বার্তা সংস্থা ইকনা'র রিপোর্ট: তিন দশকে কাশ্মীরে ঘটা জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন, ধর্ষণ ও বাকস্বাধীনতা সমপূর্ণরূপে হরণ সব সময়ই ছিল আলোচনার বিষয়। এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ, ভারতীয় সেনাবাহিনী, সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ) ও স্থানীয় বেশ কয়েকটি পাকিস্তানপন্থি গোষ্ঠী। এরমধ্যে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো দ্বারা সংঘটিত অপরাধের মাত্রা ছিল আকাশ ছোঁয়া।

বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে- ১৯৮৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত লক্ষাধিক কাশ্মীরিকে হত্যা করা হয়েছে। ভারত সরকারের হিসাব অনুযায়ীও এ সংখ্যা ৫০ হাজারের অধিক। এদের বেশিরভাগই ভারতের সেনাবাহিনীর হাতেই নিহত হয়েছে। তবে ভারত প্রথম থেকেই জম্মু ও কাশ্মীরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করে আসছে। নয়াদিল্লির দাবি, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে পাকিস্তানিরা যে হামলা চালায় তাতে ব্যাপক সংখ্যক কাশ্মীরি নিহত হয়। তবে এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে ইসলামাবাদ।
বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, ভারত কাশ্মীরে যা করেছে তা গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই না। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, ভারতীয় সেনাবাহিনী সন্ত্রাস দমনের নামে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে। ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভারত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় জঙ্গিদের টার্গেটও হয় সাধারণ মানুষই। নয়াদিল্লিভিত্তিক কাশ্মীর বিষয়ক পণ্ডিত সীমা কাজির মতে, এখানে রাষ্ট্র কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনেও একই বিষয় তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ভারতীয় সেনারা জম্মু-কাশ্মীরে সাধারণ মানুষ ও সন্ত্রাসী উভয়কেই বিচারবহির্ভূত উপায়ে হত্যা করছে।
হাজার হাজার কাশ্মীরিকে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হওয়া কাশ্মীরিদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক সংখ্যক নারী ও শিশু। এ নিয়ে জাতিসংঘ বেশ কয়েকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। হেফাজতে এত ব্যাপক সংখ্যক মৃত্যুর নিন্দাও জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটির দাবি, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী কোনো বিচার ছাড়াই কাশ্মীরিদের বন্দি করে রাখছে। ২০১০ সালে এ ধরনের নানা অপরাধের জন্য ১০৪ সেনাসদস্যকে শাস্তি দেয়া হয়। এরমধ্যে ৩৯ সেনা কর্মকর্তাও ছিলেন। তবে প্রকৃত অপরাধের তুলনায় এ শাস্তি একেবারেই নগণ্য।
আলোচিত হত্যাকাণ্ড
১৯৯০ সালের ২১শে জানুয়ারি সিআরপিএফ সদস্যরা গাওকাদাল এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। এসময় তাদের হাতে নিহত হয় ৫১ বেসামরিক মানুষ। অভিযানের সময় সেনাদের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন অনেক কাশ্মীরি নারী। ওই একই বছর সংঘটিত হয় হান্ডওয়ারা হত্যাকাণ্ড। গাওকাদালে অভিযানের ৪ দিন পর অর্থাৎ ২৫শে জানুয়ারি ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ হান্ডওয়ারায় এক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলাকালীন এ হত্যাকাণ্ড চালায়। এতে নিহত হয় ২৫ আন্দোলনকারী। এ ঘটনায় আহত হয়েছিল আরো কয়েক ডজন মানুষ। ১৯৯০ সালের ১লা মার্চ জাকুরা ও টেঙপোরা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিলে গুলি করে ৩৩ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। এতে আহত হয় ৪৭ জন। এ ঘটনায় কারো বিচার হয়নি।
১৯৯০ সালের সব থেকে আলোচিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে পরিচিত হাওয়াল হত্যাকাণ্ড। এদিন মিরওয়াইজ মুহাম্মদ ফারুকের শেষকৃত্যে ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনী গুলি চালায়। এতে নিহত হয় ৬০ বেসামরিক কাশ্মীরি ও আহত হয় আরো শতাধিক। ১৯৯৩ সালের ৬ই জানুয়ারি সোপোরে শহরে অভিযান চালানোর সময় ভারতীয় সেনাদের হাতে নিহত হয় ৫৫ বেসামরিক মানুষ। এসময় তারা ওই শহরের অনেক বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এছাড়া, ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক বিজবেহারা হত্যাকাণ্ড ও কুপওয়ারা হত্যাকাণ্ডে যথাক্রমে ৫১ ও ২৭ বেসামরিক কাশ্মীরি নিহত হয়েছিল।
ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ কার্যক্রম আরম্ভের পর থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনী, সিআরপিএফ এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা কাশ্মীরি জনগণের বিরুদ্ধে ধর্ষণকে যুদ্ধের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এই সংঘাত চলাকালে হাজার হাজার নারী ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় পাকিস্তানপন্থি সশস্ত্র বাহিনীগুলোও ব্যাপক ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত।
কাশ্মীরিদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে কৌশলগতভাবে নির্যাতন চালিয়ে আসছে ভারতীয় সেনারা। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিল। দেশটি এর পক্ষে নানা প্রমাণও ভারতীয় কূটনীতিকদের কাছে পাঠিয়েছিল। ২০১২ সালে মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করা আইনজীবী পারভেজ ইমরোজ ও তার মাঠকর্মীরা নির্যাতন নিয়ে গবেষণা শুরু করে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাশ্মীরের মানুষ জাতিগতভাবে নির্যাতিত হচ্ছে এবং তাদের ওপর চালানো নির্যাতন পুরোপুরি পরিকল্পিত। এতে বলা হয়, প্রতি ৬ কাশ্মীরির মধ্যে ১ জন কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার। মানব জমিন

captcha