IQNA

শ্রেষ্ঠ আদর্শ বিশ্বনবী (সা) ও তাঁরই নূরের এক অনন্য নক্ষত্রের কথা

21:09 - November 26, 2018
সংবাদ: 2607355
১৭ রবিউল আউয়াল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর সাদিকের পবিত্র জন্ম-বার্ষিকী।

বার্তা সংস্থা ইকনা: বিশ্বনবী (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। তাঁর শুভ জন্মদিন তাই মানব জাতির জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন এবং এই দিন মুসলমানদের মিলন ও ঐক্যের সবচেয়ে বড় শুভ-লগ্ন। এই মহাখুশির দিন উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি অশেষ মুবারকবাদ, মহান আল্লাহর প্রতি জানাচ্ছি অশেষ শুকরিয়া এবং বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি পেশ করছি অশেষ দরুদ ও সালাম।

আজ বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)'রও শুভ জন্মদিন। তাই এ উপলক্ষেও সবাইকে জানাচ্ছি মুবারকবাদ এবং এই মহান ইমামের উদ্দেশে পেশ করছি অসংখ্য দরুদ ও সালাম। ইসলামী আইনসহ এই মহান ধর্মের নানা দিক ও জ্ঞানের সব শাখা বিকশিত হয়েছিল মহান ইমাম হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)'র মাধ্যমে। তাঁর হাজার হাজার উচ্চ-শিক্ষিত ছাত্রের মধ্যে অনেক উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ও খ্যাতনামা বিজ্ঞানীও ছিলেন। ইসলামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ও এ ধর্মকে সাংস্কৃতিক বা চিন্তাগত হামলাসহ সার্বিক ক্ষতিকর দিক থেকে সুরক্ষার জন্য যা যা করার দরকার তার সবই তিনি করেছিলেন।

ইমাম জাফর আস সাদিক ৮৩ হিজরির ১৭ ই রবিউল আউয়াল মদীনায় ভূমিষ্ঠ হন। ৩৪ বছর ধরে মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব দেয়ার পর ১৪৭ হিজরির ২৫ শে শাওয়াল শাহাদত বরণ করেন। আব্বাসিয় শাসক মনসুর দাওয়ানিকি বিষ প্রয়োগ করে এই মহান ইমামকে শহীদ করে। এই মহান ইমাম সম্পর্কে আমরা আরও কথা বলব আরও কিছুক্ষণ পর।

বিশ্বনবী (সা.) ছিলেন মহামানবদেরও শিক্ষক এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ও মহান আল্লাহর সর্বশেষ অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। তাঁর পর আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না এ কারণেই যে মানব জাতির সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ও সৌভাগ্যের জন্য যা যা দরকার তার সব নির্দেশনাই তিনি দিয়ে গেছেন এবং তাঁর নির্দেশনাগুলোর যুগোপযোগী ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন তাঁরই বংশে জন্ম নেয়া পবিত্র ইমামগণ।

জাহেলিয়াতের কালো মেঘ সারা বিশ্বের ওপর যখন ছায়া মেলে রেখেছিল এবং অসৎ ও ঘৃণ্য কার্যকলাপ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ, লুটতরাজ ও সন্তান হত্যাসহ সব ধরনের নৈতিক গুণ যখন বিলুপ্ত হচ্ছিল তখনই মানব জাতির শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্য-রবির উদয় হয়। তার আবির্ভাব বিশ্ব-সভ্যতার সবচেয়ে বড় শুভ-লগ্ন। সমগ্র আরব উপদ্বীপ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মোপলক্ষে আলোকোজ্জ্বল হয়। অনতিবিলম্বে এ নূরের বিচ্ছুরণে সমগ্র জগত আলোকোদ্ভাসিত হলো এবং সমগ্র বিশ্বে এক সুমহান মানব সভ্যতার ভিত্তিও নির্মিত হয়ে গেল।

মহানবীর জন্মগ্রহণের মুহূর্তে সম্রাট খসরুর প্রাসাদের দ্বারমণ্ডপ ফেটে গিয়েছিল এবং এর কয়েকটি স্তম্ভ ধসে পড়েছিল। ফার্স প্রদেশের অগ্নি উপাসনালয়ের প্রজ্বলিত আগুন নিভে গিয়েছিল। ইরানের সাভেহ্ হ্রদ শুকিয়ে গিয়েছিল। পবিত্র মক্কার প্রতিমালয়গুলোতে রক্ষিত মূর্তি ও প্রতিমাগুলো মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। এ সব ঘটনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ঐ সব মানুষের অন্তরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয়া ও মনোযোগ সৃষ্টি করা যারা মূর্তিপূজা, অন্যায় ও জুলুমের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল।

ত্রিভূবনের প্রিয় মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন মহান আল্লাহর সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। সব নবী-রাসুলেরও নেতা তিনি।

মহানবীকে জানতে হলে আমাদেরকে ফিরতে হবে কুরআনের দিকেই। মহানবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন প্রত্যেক নবী। পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী মহানবীকে পাঠানো হয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য। কুরআনে মহান আল্লাহ বলছেন: আর আমি আপনাকে পাঠিয়েছি মানুষের প্রতি আমার পয়গামের বাহক হিসাবে। আর সাক্ষী হিসেবে মহান আল্লাহই যথেষ্ট। সুরা তওবার ৩৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

তিনিই পাঠিয়েছেন আপন রসূলকে হেদায়েত ও সত্যধর্ম সহকারে,যেন এ ধর্মকে অন্যান্য ধর্মের উপর জয়যুক্ত করেন,যদিও মুশরিকরা তা অপ্রীতিকর মনে করে।

পবিত্র কুরআনের এসব বাক্য থেকে বোঝা যায় ইসলাম ধর্ম সর্বজনীন ও তা সব ধর্ম ও মতবাদের ওপর বিজয়ী হবে। আর এটাও স্পষ্ট যে মহানবীর রেসালত ও নবুওয়ত কোনো স্থান বা অঞ্চল, বংশ, সময় ও ভাষা, বর্ণ আর গোত্রের গণ্ডীতে সীমিত নয়।

মহানবী (সা)-কে গোটা মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে পাঠাইনি বলেও পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা আম্বিয়ার ১০৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত হিসেবেই পাঠিয়েছি। অর্থাৎ বিশ্বনবী (সা) গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত। এ বিশ্বজগত টিকে আছে মহান আল্লাহর রহমতে। আর আল্লাহর সবচেয়ে বড় রহমত হলেন বিশ্বনবী (সা)। তাই তাঁকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ কিছুই সৃষ্টি করতেন না।

হযরত ইব্রাহিম ও হযরত ইসমাইল সর্বশেষ রাসুলের আগমনের জন্য দোয়া করেছিলেন। পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১২৯ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে:

হে পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের কাছে একজন পয়গম্বর পাঠান যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতগুলো তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই তুমিই পরাক্রমশালী হেকমতওয়ালা।

হযরত ঈসা (আ)ও বিশ্বনবীর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। তাওরাত ও ইঞ্জিলেও দেয়া হয়েছিল মহানবীর আগমনের সুসংবাদ। সুরা আরাফের ১৫৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, সে সমস্ত লোক, যারা আনুগত্য অবলম্বন করে এ রসূলের, যিনি উম্মী নবী, যাঁর সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত তওরাত ও ইঞ্জিলে লেখা দেখতে পায়, তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে; তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষনা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুগুলো এবং তাদের উপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে দেন এবং বন্দীত্ব অপসারণ করেন যা তাদের উপর বিদ্যমান ছিল। তাই যেসব লোক তাঁর উপর ঈমান এনেছে, তাঁর সাহচর্য অবলম্বন করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সে নূরের অনুসরণ করেছে যা তার সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে, শুধুমাত্র তারাই নিজেদের উদ্দেশ্য সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। মহান আল্লাহ তাঁকে তথা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নবীদের পবিত্র বৃক্ষ থেকে, আলোর প্রদীপ থেকে, সুউচ্চ আকাশের মত মর্যাদা ও মহত্ত্বের শীর্ষদেশ থেকে, বাত্হা’র প্রাণকেন্দ্র তথা পবিত্র মক্কা থেকে অন্ধকারের প্রদীপ এবং প্রজ্ঞার প্রস্রবণ ও উৎস থেকে নির্বাচিত ও মনোনীত করেছেন।

মহানবী যে সর্বোত্তম আদর্শ তা তুলে ধরতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।

রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, পারিবারিক, দাম্পত্য ও ব্যক্তিগত জীবন, যুদ্ধ-বিদ্যাসহ সব ধরনের শিক্ষা ও সামরিক প্রশিক্ষণসহ জীবনের এমন কোনো দিক নেই যে বিষয়ে মহানবী (সা) শ্রেষ্ঠ আদর্শ ছিলেন না। তাই মহানবীর অনুসারী বা মুসলমান হওয়ার দাবি করলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রিয় নবীজীকে শ্রেষ্ঠ আদর্শ বলে মানতে হবে। শান্তি ও সংকটকালীন সময়সহ ইসলাম ও মুসলমানদের ভবিষ্যত উন্নতি বা উন্নয়নের জন্য তাঁর সঠিক ও নিখুঁত পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টি, বিচক্ষণতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ইত্যাদি যুগ যুগ ধরে বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতদের মহা-বিস্মিত করে এসেছে। ফলে আধুনিক যুগেও বিশ্ব-ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে মহানবীকে সর্বোচ্চ ও শীর্ষ আসন দিতে বাধ্য হয়েছেন মাইকেল এইচ হার্টের মত লেখক।

দুঃখজনকভাবে কেউ কেউ প্রচার করে আসছেন যে মহানবী ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে ছিলেন না, বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়ের বাইরে দুনিয়াবি অনেক বিষয়ে তিনি সুদক্ষ ছিলেন না। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনার সময় তারা বলেন যে অমুক অমুক ঘটনায় রাসুলের চেয়েও অন্য একজন সাহাবির মতামতকে আল্লাহ বেশি পছন্দ করেছেন বা কখনও কখনও রাসুল ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অথবা ভুল পরামর্শ দিয়েছেন ওই বিষয়ে না জানার কারণে! কিংবা কোনো কোনো গুণের বিষয়ে তিনি কোনো কোনো সাহাবিকে নিজের চেয়েও বেশি উন্নত পর্যায়ের বলে মনে করতেন! এসব ধারণা খুবই ভুল ও অন্যায্য। কারণ যিনি সর্বোত্তম আদর্শ তিনি সব ক্ষেত্রেই অন্যদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী ও সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নেয়া বা দেয়ার ক্ষমতা রাখতেন এবং যে কোনো মহতী গুণে তিনি ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আর তিনি জীবনে কখনও কোনো পাপ বা অন্যায় আচরণ করেননি।

জগতবাসীকে সৎ ও পবিত্র করা ছিল বিশ্বনবীর দায়িত্ব। তাই তিনি যদি পবিত্র ও নিষ্পাপ না হন তিনি কিভাবে অন্যদের সব ধরনের পাপ ও পংকিলতা থেকে রক্ষা করবেন? এ জন্যই সুরা বাকারায় মহান আল্লাহ বলেছেন:

আমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে একজন রসূল, যিনি তোমাদের কাছে আমার বাণীগুলো পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন; আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও তাঁর তত্ত্বজ্ঞান এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয় যা কখনো তোমরা জানতে না।

বিশ্বনবী (সা) নিজেই বলেছেন, মানব-চরিত্রকে পূর্ণতা দেয়াই ছিল তাঁর রেসালাতের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, পরোপকার, সাহসিকতা ও বীরত্ব, বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সৌজন্যতা, ক্ষমাশীলতা, উদারতা ও অন্যের কল্যাণকামিতাসহ সর্বোত্তম চরিত্রের সবগুলো দিকেই তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।

বিশ্বনবী (সা) ছিলেন উম্মি। এর অর্থ তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি পৃথিবীর কারো কাছে কিংবা কোন বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেননি । কিন্তু তিনি ছিলেন জ্ঞানের এক অফুরন্ত উৎস এবং ‘ইলমে লাদুন্নীর' তথা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আত্মিকভাবে আত্মস্থকারী জ্ঞানের অধিকারী।

বিশ্বনবীকে চেনার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর পর সবচেয়ে বেশি পারদর্শি ছিলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী। তিনি বিশ্বনবী সম্পর্কে বলেছেন,

মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সাক্ষী,সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন শৈশবে সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বোত্তম এবং বয়স্কাবস্থায় তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র। তিনি ছিলেন স্বভাব-চরিত্রে সকল পবিত্র ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র। তিনি ছিলেন স্থায়ী ও অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণকারী মেঘমালার মত দানশীলদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ (দানশীল) অর্থাৎ যেসব মেঘ থেকে অবিরাম স্থায়ীভাবে বৃষ্টি বর্ষণ হতে থাকে সেসব মেঘের মত যারা স্থায়ীভাবে দান করে যায় তাদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন। হযরত আলী আরও বলেছেন:

হযরত মুহাম্মদ ছিলেন ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক যিনি রোগের উপশম দানকারী মলম প্রস্তত করে রাখতেন এবং ক্ষতস্থানে দাগ লাগানোর যন্ত্রকে উত্তপ্ত রাখতেন। যখনই অন্ধ হৃদয়, বধির কান ও বাকশক্তিহীন জিহ্বার চিকিৎসার প্রয়োজন হতো তখনই তিনি এগুলো অর্থাৎ চিকিৎসার এসব উপায়-উপকরণ দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতেন। তিনি অবহেলা-অমনোযোগ ও জটিলতার স্থানগুলোতে গভীরভাবে অনুসন্ধান করে সঠিক ঔষধ প্রয়োগ করতেন।

মহানবী সম্পর্কে হযরত আলী আরও বলেছেন: তিনি দুনিয়ার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিলেন এবং একে অতি তুচ্ছ ও গুরুত্বহীন মনে করতেন। মহানবী (সা.) মাটিতে বসে আহার করতেন, ক্রীতদাসের মত বসতেন। নিজ হাতে (তাঁর) চপ্পল সিলাই করতেন,নিজ হাতে কাপড়ে তালি দিতেন,জিন বা আসনবিহীন গাধার ওপর আরোহণ করতেন এবং (গাধার পিঠে যখন চড়তেন তখন) তিনি তাঁর পেছনে অন্য আরেকজন ব্যক্তিকেও বসাতেন। একবার তাঁর বাড়ীর দরজার ওপর এমন একটি পর্দা টাঙ্গানো হয়েছিল যার মধ্যে কিছু ছবি অংকিত ছিল। এ কারণে তিনি (তা দেখে) তাঁর একজন স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,“হে অমুক,পর্দাটি আমার (চোখের সামনে) থেকে সরিয়ে ফেল। কারণ যখনই আমি ঐটির দিকে তাকাই তখনই দুনিয়া ও এর চাকচিক্যের কথা আমার স্মরণ হয়। তিনি মন ও হৃদয় থেকে দুনিয়াকে বের করে দিয়েছিলেন এবং দৃষ্টি শক্তির সীমা থেকে দূর করেছিলেন। আর ঠিক একইভাবে যে ব্যক্তি কোন জিনিসকে অপছন্দ ও ঘৃণা করে আসলে সে ঐ জিনিসটির প্রতি দৃষ্টি দিতে (তাকাতে) এবং ঐ জিনিসটির আলোচনা ও স্মরণ করতেও ঘৃণাবোধ করে।

রাসূল (সা.)-এর আত্মিক ও শারীরিক ক্ষমতা

রোমান লেখক কুনেস্টান ভিরজিল গিওরগেভ তাঁর "নবী মুহাম্মদকে নতুন করে চিনুন"শীর্ষক গ্রন্থে দু'টি বিষয় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন (যদিও গ্রন্থটিতে প্রচুর ভুল তথ্য রয়েছে। কারণ ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের কোন ব্যক্তির পূর্ণ ধারণা থাকাটা অস্বাভাবিক, তা সত্ত্বেও তিনি এ দু'টি বিষয়কে সুন্দরভাবে চিত্রিত করতে সক্ষম হয়েছেন)। একটি হলো রাসূল (সা.)-এর দৃঢ়তা। রাসূল(সা.) কখনো কখনো এমন অবস্থায় পড়তেন যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্ভাবনার সব দরজাই তাঁর সামনে বন্ধ হয়ে যেত, পরিস্থিতি চলে যেত সম্পূর্ণ প্রতিকুলে এবং আশার কোন আলোই অবশিষ্ট থাকত না, কিন্তু সেসব মুহূর্তেও তিনি অবিচল থাকতেন, তাঁর ইচ্ছাশক্তি পর্বতের মতো অটল থাকতো। রাসূল (সা.)-এর তেইশ বছরের নবুওয়াতী জীবনে তাঁর অপরিসীম মানসিক শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। মানুষ যখন তা অধ্যয়ন করে তখন অভিভূত হয়। এজন্যই কবি হাসসান বিন সাবিত (রাসূলের(সা.) সাহাবী ও প্রসিদ্ধ কবি) বলেছেন,

لَهُ هِمَمٌ لاَ مُنْتَهَى لِكِبَارِهَا وَ هِمَّتُهُ الصُّغْرَى أَجَلُّ مِنَ الدَّهرِ

তাঁর বড় হিম্মতের কোন সীমা নেই এবং তাঁর ক্ষুদ্র হিম্মত কালের চেয়েও মহিমান্বিত।

রাসূল (সা.) বাহ্যিক শক্তি ও ক্ষমতায় যেমন শক্তিশালী মানুষ ছিলেন তেমনি তাঁর সুঠাম দেহ সাহসিকতার স্বাক্ষর বহন করত। রাসূল(সা.) মোটাও ছিলেন না আবার শীর্ণও ছিলেন না বরং মধ্যম শরীরের অধিকারী ছিলেন। তাঁর পেশীগুলো পরস্পর সংযুক্ত ও দৃঢ় ছিল, স্থুল দেহের মানুষের মতো তাঁর পেশী ঢিলা ছিল না।

রাসূলের(সা.) সাহসিকতা এ পর্যায়ের ছিল যে, স্বয়ং আলী (আ.) বলেছেন,

وَ كُنَّا إِذَا احْمَرَّ الْبَأْسُ اتَّقِيْنَا بِرَسُوْلِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَ آلِهِ

কখনো কখনো পরিস্থিতি যখন আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ত, আমরা রাসূল (সা.)-এর কাছে আশ্রয় নিতাম।

যদি কেউ মহানবীকে অসম্মান করত তিনি তার প্রতিশোধ নিতেন না। অন্যদের ভুল ও দুর্ব্যবহারকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন। তাদের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিপরীতে ক্ষমা মহানুভবতা এবং বদান্যতা প্রকাশ করতেন।

কুরাইশদের শত অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করে ও তিনি মক্কা বিজয়ের পর তাদেরকে ক্ষমা করেছিলেন এবং মুক্তি দিয়েছিলেন।

ওহুদের যুদ্ধে ওয়াহশী নামক এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর চাচা হযরত হামজাকে শহীদ করেছিল কিন্তু তিনি তাকে ক্ষমা করেছিলেন। অনুরূপভাবে আবু সুফিয়ান ও হিন্দা যারা রাসূল (সা.)-এর প্রতি চরম অবিচার করেছিল তাদেরকেও ক্ষমা করেছিলেন এবং কখনোই প্রতিশোধের চিন্তায় ছিলেন না। তবে তিনি এতবেশি দয়াশীল ও ক্ষমাশীল হওয়া সত্ত্বেও যদি কখনো কেউ ইসলামের সীমারেখাকে অতিক্রম করত কোনরূপ নমনীয়তা দেখাতেন না। মহানবী যখন জানতে পারলেন “ফাতিমাহ মাখযুমী” চুরি করেছে তখন ওসমান বিন যাইদের মধ্যস্থতায় উত্থাপিত শাস্তি মাফের সুপারিশে কর্ণপাত করলেন না। তিনি বললেন :

পূর্ববর্তী গোষ্ঠীগুলোর ধ্বংস ও বিলুপ্তি এ কারণে হয়েছিল যে, তারা সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকদের উপর শরীয়তের হুকুম জারী করত না। আল্লাহর শপথ! যদি আমার কন্যা “ফাতেমা যাহরা” এহেন কর্ম করত আমি তার হাত কেটে ফেলতাম।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ২৩ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে উপহার দিয়ে গেছেন পবিত্র ইসলাম ধর্ম। এ ধর্ম একটি পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ ও চিরন্তন ধর্ম হিসেবে কোন বিশেষ জাতি বা গোত্রের জন্য সীমিত নয়। তাই ইসলামী ঐক্য রয়েছে এ ধর্মের রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচীর শীর্ষে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে বিশ্বনবী (সা.) ঈমানের ছায়াতলে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের সংস্কৃতি উপহার দিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনের আয়াতের আলোকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মুসলিম সমাজকে আল্লাহর রশি শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে ও পরস্পর বিবাদ বা বিচ্ছিন্নতা পরিহার করতে বলেছেন। মুসলমানরা যতদিন তাঁর বাণী মান্য করেছিল ততদিন তারা শত্রুদের ওপর বিজয়ী হয়েছিল এবং এর ফলে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে।

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের ফলেও বর্তমান বিশ্বে আবারো ইসলামী ঐক্য ও মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণ লক্ষ্যনীয়। ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) ছিলেন ইসলামী ঐক্যের অন্যতম বড় আহ্বায়ক। তার বিপ্লবী আন্দোলন শুরুর প্রথম থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেসব বাণী বা আহ্বান তিনি রেখে গেছেন তার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পেয়েছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য। মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) ১২ থেকে ১৭ ই রবিউল আউয়ালকে মুসলমানদের জন্য ঐক্য সপ্তাহ বলে ঘোষণা করেছেন। সুন্নি মুসলমানদের মতে বিশ্বনবী (সা.) ১২ ই রবিউল আউয়াল এবং শিয়া মুসলমানদের মতে তিনি ১৭ ই রবিউল আউয়াল জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ইমামের এ উদ্যোগ ইসলামী ঐক্য জোরদারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এবার আমরা কথা বলব বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ও তাঁর অন্যতম সুযোগ্য উত্তরসূরি ইমাম জাফর সাদিক (আ) সম্পর্কে। ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) যে অভাবনীয় ও অতুল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তা ছিল নবুওতী জ্ঞানেরই উত্তরাধিকার। তিনি বলতেন, আমার বক্তব্য আমার পিতা তথা ইমাম বাকের (আঃ)'র বক্তব্য, আমার পিতার বক্তব্য আমার দাদা তথা ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ)'র বক্তব্য, আমার দাদার বক্তব্য হচ্ছে আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ)'র বক্তব্য এবং তাঁর বক্তব্য হচ্ছে রাসূল (সাঃ)'রই বক্তব্য, আর রাসূলে খোদা (সাঃ)'র বক্তব্য হচ্ছে মহান আল্লাহরই বক্তব্য।

ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) বলেছিলেন,আমাদের তথা রাসূল (সাঃ)'র আহলে বাইতের কাছে রয়েছে ভবিষ্যতের জ্ঞান,অতীতের জ্ঞান,অন্তরে অনুপ্রাণিত বা সঞ্চারিত জ্ঞান,ফেরেশতাদের বাণী যা আমরা শুনতে পাই,আমাদের কাছে রয়েছে রাসূল (সাঃ)'র অস্ত্রসমূহ এবং আহলে বাইতের সদস্য ইমাম মাহদী (আঃ)'র কাছে না পৌঁছা পর্যন্ত সেগুলো আমাদের হাতছাড়া হবে না। আমাদের কাছে রয়েছে হযরত মূসা (আঃ)'র তৌরাত,হযরত ঈসা (আঃ)'র ইঞ্জিল, হযরত দাউদ (আঃ)'র যাবুর এবং মহান আল্লাহর পাঠানো অন্যান্য আসমানী কেতাব।

এ ছাড়াও আমাদের কাছে রয়েছে হযরত ফাতেমা (সঃ)'র সহিফা যাতে রয়েছে সমস্ত ভবিষ্যৎ ঘটনার বিবরণ এবং পৃথিবীর শেষ ঘণ্টা পর্যন্ত সমস্ত শাসকের নাম তাতে লেখা আছে। আমাদের কাছে রয়েছে আল জামী নামের দলীল,সত্তুর গজ দীর্ঘ ঐ দলীলে লেখা রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)'র নিজ মুখের উচ্চারিত ও নির্দেশিত বাণী এবং ঐসব বাণী আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ) নিজ হাতে লিখেছিলেন। আল্লাহর শপথ! এতে রয়েছে মানুষের জন্যে কিয়ামত পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সবকিছু।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যরা সব সময়ই অন্য যে কোনো ব্যক্তিত্ব বা শাসকদের চেয়ে মানুষের বেশী শ্রদ্ধা ও গভীর ভালবাসার পাত্র ছিলেন। আর এ জন্যে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ও ক্ষমতাসীন শাসকরা এই মহাপুরুষগণকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন এবং ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। আব্বাসীয় খলিফা আল মানসুর ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) 'র ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও প্রভাব প্রতিপত্তি দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তারই নির্দেশে ১৪৮ হিজরীর ২৫ শে শাওয়াল বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করা হয় নবী বংশ তথা আহলে বাইতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র ইমাম জাফর সাদেক (আঃ)কে। কিন্তু বস্তুবাদী শাসকচক্রের অন্ধ স্বার্থপরতার সীমানা পেরিয়ে অন্য অনেক মহান ইমামের মতোই ধার্মিক মানুষের অন্তরের রাজ্যে আজো ক্ষমতাসীন হয়ে আছেন হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)।

ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)মুসলমানদের সব মাজহাবের কাছেই বরেণ্য ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তাঁর আদর্শ হতে পারে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের সূত্র। চারজন সুন্নি ইমামের মধ্যে একজন তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্র এবং আরো দুই জন সুন্নি ইমাম তাঁর পরোক্ষ ছাত্র ছিলেন।

মালিকি মাজহাবের ইমাম মালেক বিন আনাস ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.) সম্পর্কে বলেছেন, আল্লাহর শপথ! মানুষের কোনো চোখ সংযম সাধনা, জ্ঞান, ফজিলত ও ইবাদতের ক্ষেত্রে জা’ফর ইবনে মুহাম্মাদের চেয়ে বড় কাউকে দেখেনি, কোনো কান এসব ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে বড় কারো কথা শুনেনি এবং কোনো হৃদয়ও তা কল্পনা করেনি।

ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র একটি অমূল্য বাণী শুনিয়ে শেষ করব আজকের আলোচনা। তিনি বলেছেন,

যারা নামাজকে গুরুত্বহীন মনে করবে আমাদের তথা বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের শাফায়াত তাদের ভাগ্যে জুটবে না।

আজকের এই মহাখুশির দিন উপলক্ষে আবারও সবাইকে জানাচ্ছি অশেষ মুবারকবাদ, মহান আল্লাহর প্রতি জানাচ্ছি অশেষ শুকরিয়া এবং বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি পেশ করছি অশেষ দরুদ ও সালাম।

captcha